আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই বিশাল তেঁতুল গাছটি। দীর্ঘ জীবনে কত যে ঘটনার সাক্ষী হয়েছে এটি- তা কেউ হিসাব করে বলতে পারবে না। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এ মহীরুহটির বয়স ৫০০ বছরের বেশি। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটিতে এখনো ফুল ফোঁটে, ধরে ফল। প্রজনন মৌসুমে বাসা বাঁধে বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের শুড়লা গ্রামের এ বৃক্ষটি আজও স্থানীয়দের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয়া জানান, বছরের পর বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এ রাজকীয় গাছটি। এটির আকার যেমন বিশাল তেমনি উচ্চতার দিক দিয়েও এটি আশপাশের অন্যান্য গাছের তুলনায় অনেক বড়। আগে এর উচ্চতা আরো বেশি ছিলো। ২০০০ সালে গাছটির সবচেয়ে উঁচু ডালটি ভেঙে পড়ে। তারপরও গাছটির উচ্চতা আশপাশের অন্য গাছের তুলনায় বেশি। তারা আরো জানান, গাছটি ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলনের সাক্ষী। গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক বৃদ্ধরা তাদের বাপ-দাদাদের কাছ থেকে গাছটির আকৃতি সম্পর্কে যেমন গল্প শুনেছেন, এখনো ঠিক তেমনই আছে। এটি তাদের কাছে ঐতিহ্য ও প্রাচীন নিদর্শন স্বরূপ। তাই এর কোনো ক্ষতি করেনা এলাকাবাসী।
জানা যায়, প্রতি বছর প্রজনন মৌসুমে কয়েক শ বক এ গাছটিতে বাসা বাঁধে। এরপর সেখানে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বড় হয়ে এক সময় বাচ্চাগুলোও উড়ে চলে যায়। আবার প্রজনন মৌসুম আসলে বাসা বাঁধতে আসে বকের দল। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে এখানে নির্বিঘ্নে প্রজনন করছে বক। এমনকি গ্রামের কেউ বকগুলোকে শিকারও করে না। তাই নিরাপদেই গাছটিতে পুরো প্রজননকাল কাটায় বকেরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শুড়লা গ্রাম। গ্রামে ঢুকতেই দূর থেকে চোখে পড়ে এই প্রাচীন বৃক্ষটি। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু দর্শনার্থী বিশাল এ মহীরুহটিকে দেখতে আসে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য গাছটির পাশে টিনের ছাউনি দিয়ে গোল করে একটি বসার ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। প্রাচীন এ বৃক্ষের কারণে আজ সারাদেশেই পরিচিত এই শুড়লা গ্রাম।
তবে ২০০৩ সালের আগে এই গাছের বয়স সম্পর্কে জানতো না গ্রামবাসীরা। স্থানীয় ইতিহাসবিদ ও নবাবগঞ্জ সরকারী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাযহারুল ইসলাম জানান, ওই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক নূরুল হক গাছটি সম্পর্কে জানতে পারেন। পরে তিনি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গাছটির বয়স পরীক্ষা করান। তখন বিশেষজ্ঞরা গাছটির বয়স ৫০০ বছরেরও বেশি বলে নিশ্চিত করেন। তারপর থেকে গাছটি দেখভালের দায়িত্ব নেয় জেলা প্রশাসন।
গাছটির যাতে কেউ ক্ষতি না করে আর গাছটির প্রাচীন ইতিহাস দর্শনার্থীদের জানানোর জন্য গাছের গোড়ায় টানানো হয়েছে একটি সাইনবোর্ড। যেখানে লেখা রয়েছে- এ গাছটি অতিপ্রাচীন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর বয়স অন্তত ৫০০ বছর। অতিকায় এই বৃক্ষটি ভৌতিক, সামাজিক, জৈবিক ও পরিবেশগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এর সংরক্ষণের জন্য গাছটির কোনো ক্ষতি বা গাছে বাসা বাঁধা কোনো পাখি, পাখির ডিম, ছানার দিকে ঢিল ছোঁড়া যাবে না। অন্যথায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেভ দ্য নেচার’র চাঁপাইনবাবগঞ্জের সমন্বয়ক ফয়সাল মাহমুদ বলেন, একটি গাছ মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদন অক্সিজেন উৎপন্ন করে। পাশাপাশি পরিবেশের সৌন্দর্য্য বর্ধনসহ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, ক্ষয়রোধ, বৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, বিভিন্ন প্রাণীর খাদ্যের যোগান দিয়ে থাকে। একটি গাছকে ঘিরে সেখানে বসবাসকারী প্রাণীদের বাস্তুসংস্থান তৈরি হয়। তাই এ ধরনের প্রাচীন বৃক্ষ পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো দেখভাল করা মানুষের নিজেদের জন্যই প্রয়োজন।
Leave a Reply