1. admin@bomkesh.news : admin :
শুক্রবার, ২৪ মার্চ ২০২৩, ১০:১৬ পূর্বাহ্ন

শুভ জন্মদিন সুরকার “পঞ্চম”

  • আপডেট সময় : সোমবার, ২৭ জুন, ২০২২
  • ১১২ বার পঠিত

প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক, সুর সাধক রাহুল দেব বর্মণ ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। রাহুলের বাবা জগদ্বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ সুরকার গায়ক শচীন দেববর্মণ এবং মা মীরা দাশগুপ্ত ছিলেন গীতিকার। ত্রিপুরার চন্দ্রবংশীয় মাণিক্য রাজপরিবারের সন্তান হলেও তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। পরবর্তীকালে, কাজের সূত্রে তিনি বসবাস শুরু করেন বম্বে শহরে। কিন্তু, মনেপ্রাণে ছিলেন একেবারেই বাঙালী। বাবার পথ ধরেই সুরের ঝরণায় গা ভাসিয়েছেন ছেলে। সংগীত পরিবেশে বেড়ে ওঠা রাহুল একসময় হয়ে ওঠেন ভারতের জনপ্রিয় গায়ক এবং সুরকার।

আর. ডি. বর্মণের বাবা কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা শচীন দেব বর্মণ জন্মেছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরে আর পিতামহ বাস করতেন কুমিল্লাতে। পূর্বপুরুষ ত্রিপুরার রাজপরিবার। তবে পঞ্চম কখনও পিতৃভিটায় যাননি। শচীনদেব বর্মণের একমাত্র ছেলে রাহুল। ঠাকুমা ডাকতেন ‘টুবলু’ নামে। কেউ কেউ বলে থাকেন সা রে গা মা পা এর ‘পা’ ধ্বনি দ্বারা রাহুল একদম ছোটোবেলায় ক্রন্দন করতেন তাই তার নাম সা রে গা মা পা এর পঞ্চম ধ্বনি অনুযায়ী পঞ্চম হয় বা ‘প’ অক্ষর থেকে পঞ্চম রাখা হয়। কেউ কেউ আবার এও বলেন যে অভিনেতা অশোক কুমার রাহুলের ডাকনাম পঞ্চম রেখেছিলেন।

আর.ডি. বর্মণ প্রথম ভারতীয় সংগীত জগতকে পরিচয় করিয়েছিলেন ইলেকট্রিক গিটার, রক অ্যান্ড রোলের সংমিশ্রণ। এভাবেই তিনি জাদু দেখিয়েছিলেন ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছবির ‘আজা আজা ম্যায় হু পেয়ার তেরা’ গানে। ওই যুগে শুধু আর. ডি. বর্মণের গান ও সুর ব্যবহারের জন্য অনেকেই ছবি বানাতেন! তার করা গান আর সুরের নতুন নতুন সংস্করণ আজও বিভিন্ন সিনেমায় ব্যবহার করা হয়।

বলা যায়, আর ডি বর্মনের হাত ধরেই প্রথম ভারতীয় সংগীতে ঢুকে পড়ে পাশ্চাত্য সংগীত। যখন এই কান্ড তিনি ঘটান তখন ইন্টারনেট দূরে থাক ভারতবর্ষে খুব কম লোকের কাছে বিদেশি গানের রেকর্ড পাওয়া যেত। ১৯৬৫ সালে মেহমুদ সাব “ভূত বাংলা” ছবির মিউজিকের দায়িত্ব দেন অন্তরঙ্গ বন্ধু পঞ্চমের হাতে। মেহমুদ সাব-কে যারা চেনেন তাঁরা জানেন কতটা প্রানবন্ত ছিলেন তিনি এবং তাঁর অভিনয়। পঞ্চম ঠিক করেন এলভিস প্রেসলির দৌলতে সেই সময়ে প্রচন্ড জনপ্রিয় টুইস্টিং নাচের ওপর একটা গান কম্পোজ করবেন, আর যাতে কোমর দোলাবেন মেহমুদ-সাব নিজে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, চাব্বি চেকারের “লেটস টুইস্ট এগেন”-এর অনুকরণে লিখে ফেললেন ” আও টুইস্ট করে”। আর গাইলেন মান্না দে।

বাবা শচীনদেব বর্মন অভিমানে অনেক দিন কথা বলেননি এই গান শুনে। শচীন কর্তার মনে হয়েছিল এই গানের সুর মোটেই ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না। কিন্তু ততদিনে পঞ্চমকে আর ধরে কে! সংগীতের বরপুত্র ততদিনে বানিয়ে ফেলেছেন “তিসরি মঞ্জিল”- এর বিখ্যাত সব গানের সুর। ‘আজা আজা ম্যয় হুঁ পেয়্যার তেরা’, ‘ও হাসিনা জুলফোওয়ালি জানে জাঁহা’ যা ছিল পশ্চিমী ক্যাবারের অনুকরণে বানানো। এর পাশাপাশি আরো দুটো গান ছিল ‘ও মেরে সোনা রে সোনা রে’ ও ‘তুমনে মুঝে দেখা’ যা দিয়ে পঞ্চম মিউজিক ডিরেক্টর হিসাবে প্রথমবারের জন্য সাফল্যের সিঁড়িতে পা রাখেন। তারপর শুরু হয় আর ডি-র যুগ। বাবা শচীন দেব বর্মনের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজের একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি করেন পঞ্চম। ৬০ এর দশকের শেষ দিকের বলিউড জেনে যায় মাঝারি মাপের চিত্রনাট্যও পঞ্চমের সুরের যাদুতে হয়ে ওঠে মিউজিক্যাল হিটস।

আর ডি বর্মনের শাস্ত্রীয় সংগীতের হাতেখড়ি হয় উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের হাতে। সেসময় পঞ্চম শুধু বিদেশি সংগীত নিয়ে পড়ে থাকেননি, শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়েও বেশ কিছু কাজকর্ম করেছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন গুলজার সাহেবের লেখা আর কিশোর কুমারের গলা। আর ডি, গুলজার আর কিশোর কম্বিনেশন বলিউড কাঁপিয়ে দেয়। সত্তরের দশক ছিল আর ডি-র দশক। কি সব গান বেরিয়ে এসেছিল এই তিনজনের যুগলবন্দীতে! ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’, ‘ও মাঝি রে আপনা কিনারা’, ‘তেরে বিনা জিন্দেগী সে কোয়ি’, ‘তুম আ গ্যায়ে হো নুর আ গ্যায়া হ্যায়’, ‘আনেওয়ালা পল জানেওয়ালা হ্যায়’।

কিশোর কুমারের সাথে একটা আলাদা সম্পর্ক ছিল আর ডি-র। শুধু রাগপ্রধান গান গাওয়া ছাড়াও কিশোরের গলায় ও রাজেশ খান্নার লিপে আর ডি ভারতবর্ষকে সুরমূর্ছনায় ডুবিয়ে রেখেছিলেন একটা গোটা দশক। কিছু গানের শুরুতে এমন কিছু আওয়াজ তৈরি করেন যা সেইসময় তাঁর সমসাময়িক মিউজিক ডিরেক্টররা হয়তো ভাবতেই পারতেন না। কিন্তু তিনি তো সরস্বতীর বরপুত্র। তাই অনায়াসে অমন শব্দ সৃষ্টি করে গেছেন। যেমন ‘শোলে’ সিনেমায় ‘মেহবুবা মেহবুবা’ গানের আগে ফাঁকা বোতলের শব্দ, ‘পড়োসন’ সিনেমায় ‘মেরে সামনেওয়ালি খিড়কি’ গানের আগে চিরুনি ঘষার শব্দ, ‘ইঁয়াদো কি বারাত’ সিনেমায় ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে যো দিল কো’ গানের আগে বোতলের গায়ে কাঁটা চামচ ঠোকার শব্দ।

হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে ‘শোলে’ হল এমন একটা সিনেমা যার পর থেকে হিন্দি সিনেমার একটা নতুন ধারা তৈরি হয়ে ছিল। সব গানের মধ্যে সেরা ছিল ‘মেহবুবা মেহবুবা’ গানটি। গানটি পঞ্চম লিখেছিলেন আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য। কিন্তু আশাজি বেঁকে বসেন ওই চড়া সুর শুনে। তখন নিজেই গানটি রেকর্ড করেন আর সিনেমায় চালিয়ে দেন যা সুপার ডুপার হিট হয়ে যায়। শোলের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বানিয়েছিলেন হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘গুড ব্যাড আগলি’-র অনুকরণে। আর অমিতাভের লিপের মাউথ অরগ্যানের সেই সুর আজও বহু মানুষের সেলফোনের রিংটোন হিসাবে বেজে চলে। এটাই আর ডি, যার সুর আজকেও ভীষণ ভীষনভাবে প্রাসঙ্গিক।

হিন্দি গানের জন্য সুনাম কুড়ালেও সবার প্রিয় পঞ্চমদা আগাগোড়াই ছিলেন একজন বাঙালি। সারাজীবনে মোট ৩৩১টি ছবির সুরকার হিসাবে কাজ করেছেন আর ডি বর্মন যার মধ্যে ছিল ২৯২টি হিন্দি, ৩১টি বাংলা, ৩টি তেলেগু, ২টি তামিল, ২টি ওড়িয়া ও ১টি মারাঠি ছবি। এরপরেও একটা মানুষকে ৮০এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কাজ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হত। একটা সময় ছিল যখন দিনের পর দিন একা একা বসে থেকেছেন নিজের মিউজিক রুমে। তবুও যেসব ছবিতে যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই নিজের ছাপ ছেড়েছেন পঞ্চম।

ব্যক্তিগত জীবনে রাহুল দেব বর্মণ ১৯৬৬ সালে প্রথম বিয়ে করেন রিতা প্যাটেলকে। দার্জিলিংয়ে পরিচয় হয়েছিল তাদের। রিতা ছিলেন পঞ্চমের অন্ধভক্ত। পাঁচ বছরের মাথায় তাদের বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। এরপর ‘পরিচয়’ (১৯৭২) ছবির ‘মুসাফির হু ইয়ারো’ গানটি হোটেলে বসে সুর করেছিলেন আর. ডি. বর্মণ। ১৯৮০ সালে তিনি বিয়ে করেন প্রখ্যাত গায়িকা আশা ভোঁসলেকে। এই সংগীত দম্পতি একসঙ্গে অনেক কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের।

রাহুল দেব বর্মনের কালজয়ী কিছু বাংলা গান – ও আমার ময়না গো, মনে পড়ে রুবী রায়, যেতে যেতে পথে হল দেরি, তুমি কতো যে দূরে, রূপসী বলনা কে বেশি, রিমঝিম বৃষ্টি, অঝোর ধারা, যেতে পার, যাবেই যদি গো চলে, কি হবে আর পুরনো দিনের কথা, চোখে নামে বৃষ্টি, কোথা কোথা খুঁজেছি তোমায়, একটি কথা হায় সে তো, ফিরে এলাম দূরে গিয়ে, ভেবেছি ভুলে যাব, পারিনা তো ভুলিতে, প্রেম কিসে হয় তা কেউ কি জানে, আজি দোলে মন কার ইশারায়।

ভারতীয় সংগীত জগতে আর ডি বর্মনের চেয়ে বড় সুরকার নেই বললেই চলে। এমনকি তাঁর বাবা শচীন কত্তা যাকে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সুরকার মানতেন সেই সলিল চৌধুরী আর ডি বর্মনের মৃ’ত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেন,
“Regal music in Hindi films has come to an end. The contribution of the Burmans to Hindi film music is unique in their own dimensions, very difficult to touch.”

জীবন সায়াহ্নে এসে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল হয়ে পড়েছিলেন আর. ডি. বর্মণ। ১৯৯৪ সালের ৪ জানুয়ারি মারা যান তিনি। কিংবদন্তি এই শিল্পীর সুরের জাদু আজও সমানভাবে নাড়া দেয় শ্রোতাদের। এই ক্ষণজন্মা সুরকার, গায়ক রাহুল দেব বর্মনের জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা

© All rights reserved © 2022 Bomkesh.News
Theme Customized By Shakil IT Park