এক যে ছিলেন রাজকন্যা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যার নামের সঙ্গে রাজকীয় তকমাটি জড়িয়ে ছিলো। কুঁচ রাজা জিতেন্দ্র নারায়ণের কন্যা গায়ত্রী দেবী। ১৯১৯ সালের ২৩ মে জন্ম নেন এই রাজকন্যা। প্রাচীন কালে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তরে বিস্তীর্ণ গারো অঞ্চল থেকে পশ্চিমে রংপুরের তিস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত কামরুপ কামাক্ষা (কামতা) রাজ্য ভেঙে বৃহত্তর রংপুর এলাকা নিয়ে তৈরি হয় এই কুঁচ রাজ্য। আরও পরে এরা রাজ্য বিস্তার শুরু করে। দখল করে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) পর্যন্ত। ওদিকে করতোয়া নদী ধরে এগিয়ে তারা দখলে নেয়, সেন রাজার বিশাল অংশ। (বৃহত্তর বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ এলাকা)। সুলতানি আমলে এদের তেমন কোন তৎপরতার ইতিহাস জানা না গেলেও, মোগল আমলে এরা কোনঠাসা হতে থাকে। এক পর্যায়ে মোগল সরকারকে কর দেয়ার শর্তে কুুঁচ একটি রাজ্য হিসেবে টিকে থাকে। মহারাজা থেকে রাজাতে সীমাবদ্ধ, এদের রাজ্য ছিলো বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল নিয়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরে বৃটিশ সরকারের সঙ্গেও তারা প্রায় একই রকম শর্তে নিজেদের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত রাখে। সে সময় এদের রাজকীয় বাড়ি এবং রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় বিহার নামক একটি স্থানে। যা এখন কুচবিহার হয়ে উচ্চারণ ভেদে কোচবিহার হিসেবে পরিচিত। কু্ঁচ একটি ক্ষুদ্র ফল। প্রবীণ যারা তারা দেখেছেন স্বর্ণের রতি মাপা হতো এই ফল দিয়ে। উজ্জ্বল রক্তিম বর্ণ, পেছনে কালো একটি “মেঘবরণ” রেখা। জানিনা এই কুঁচ রাজাদের গায়ের বরণ এমন ছিলো কিনা। তবে রাজকন্যা গায়ত্রীর ছিলো। বলা হয়,”মায়ের সকল সৌন্দর্য যেন উদ্ভাসিত হয়েছিলো গায়ত্রী দেবীর মধ্য দিয়ে। বাল্যকালে বিদেশে পড়লেও তাঁর মুল পড়াশোনা কবিগুরুর “শান্তি নিকেতনে”। বিয়ে হয়েছিলো জয়পুরের রাজপুত্র মানসিংহ ২ এর সঙ্গে। পরে মানসিংহ ২ রাজা হলে তিনি হন জয়পুরের মহারানী। ভারতের ফ্যাশন জগতের রাজকন্যাও তিনি। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন “VOGUE” ম্যাগাজিন তাঁকে একবছর বিশ্বের সেরা সুন্দরী নির্বাচন করে। “VOGUE” ম্যাগাজিনের বিবেচনাই সে সময় বিশ্বের সেরা সুন্দরীর মাপকাঠি। সে সময় মিস ওয়ার্ল্ড বা মিস ইউনিভার্স শুরু হয়নি। মিস ওয়ার্ল্ড শুরু হয় ১৯৫১ সালে, মিস ইউনিভার্স শুরু হয় ১৯৫২ সালে। গায়ত্রী দেবী গোটা ভারতে ফ্যাশন জগতের এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। ১৯৪৭ এ ভারত স্বাধীন হয়। সে সময় রংপুর বিভক্ত হয়ে বিশাল অংশ চলে আসে তদানিন্তন পুর্ব পাকিস্তানে। এই অঞ্চলে কুঁচ রাজত্ব চলে যায়। ১৯৫০ সালে ভারতেও এই রাজত্ব বিলুপ্ত হয়। বিহার হয়ে যায় কোচবিহার জেলা। জয়পুর ভারতের একটি রাজ্যের রাজধানীর মর্যাদা পায়। গায়ত্রী দেবী এ সময় ফ্যাশন দুনিয়া থেকে রাজনীতিতে যোগ দেন। লোকসভা নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গায়ত্রী দেবী যে বিশাল ব্যাবধানে কংগ্রেস প্রার্থীকে পরাজিত করেন, তা আজও ‘গীনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ এ লিপিবদ্ধ রয়েছে। কোন স্বতন্ত্র প্রার্থীর ‘রুলিং পার্টির’র বিরুদ্ধে নির্বাচন করে এমন ব্যবধানে বিজয়ী হবার ঘটনা আর ঘটেনি। রাজ প্রথা বিলুপ্ত হলেও গায়ত্রী দেবীর রাজকীয় তকমা অব্যাহত ছিলো। কারণ তাঁর ছেলের বিয়ে হয়েছেলো থাইল্যান্ডের রাজকন্যার সঙ্গে। আমৃত্যু তিনি ছিলেন থাইল্যান্ড রাজার বিয়ান, থাই রাজকন্যার শাশুড়ী। গায়ত্রী দেবী ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই প্রয়াত হন। শ্রদ্ধা এই রাজকীয় নারীর প্রতি।
Leave a Reply