ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর পুন্ড্রনগর । Pundranagar । Mahasthangarh
বন্ধুরা আজ আমরা মহাস্থানগড়ে টিকে থাকা বেশকিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন নিয়ে কথা বলব।
জিয়ত কুন্ড:—
জিয়ৎ কুন্ড নামে পরিচিত এ কূপটির নির্মাণ সম্পর্কিত কোনো সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রাজা পরশুরাম প্রসাদ নির্মাণের সময় কূপটি খনন করেন।
জিয়ৎ কুন্ড অমর কূপ নামে বেশি পরিচিত। এ কূপটির উপরিভাগের ব্যাস ৩ দশমিক ৮৬ মিটার ও নিচের দিকে ক্রমহ্রস্বমান। এই কূপের ধারে রয়েছে চতুর্ভূজ গ্রানাইট পাথরের খণ্ড। এই কূয়া পানি উত্তোলনের সুবিধার্থে ব্যবহার করা হতো বলে মনে করা হয়। কূপের তলদেশ পযর্ন্ত দুইটি সারিতে আরো অনেকগুলো প্রস্তরখন্ড আংশিক বাইরে রেখে দেয়ালের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা হয়েছে। যেন সহজে কোনো কিছু উত্তোলন করা যায়।
এবার আমরা রাজা পরশুরামের প্রাসাদের দিকে যাব।ইতিহাস বলছে, পরশুরামের প্রাসাদটি ইতিহাসের অন্যতম দুর্দান্ত নিদর্শন। এটি ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ের সীমানা প্রাচীরের ঘেরের মধ্যে পাওয়া প্রাচীন সভ্যতার অনন্য এক সাক্ষী। স্থানীয়ভাবে এটি হিন্দু রাজা পরশুরাম প্রাসাদ হিসেবে পরিচিত। রাজা পরশুরাম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনাদের জানাতে চাই। স্রটি হলো তিনি পুরাণে বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার ছিলেন। পরশুরাম ত্রেতা যুগের রাজা ছিলেন। পরশুরামের পিতা জামদগনি ব্রাহ্মণ হলেও মা রেণুকা ছিলেন ক্ষত্রিয়। কঠোর প্ররিশ্রম করে তিনি শিবের নিকট হতে পরশু লাভ করেছিলেন।
এদিকে ১৯০৭, ১৯৬১ ও ১৯৯৫ সালে মোট তিন বার এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ পরিচালনা করে তিনটি নির্মাণ যুগের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অনুমান করেন যে, দ্বিতীয় পর্বটি সুলতানি আমলে ১৫ শতকে নয়তো ১৬ শতকে নির্মাণ করা হয়েছিল। এছাড়াও, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়কালে দুটি মুদ্রা পাওয়া গেছে।
সুলতানী আমলের ইমারতের নিচে প্রথম পর্যায়ে নির্মিত ইমারতের ভবনাবশেষসহ পোড়ামাটির চিত্রফলক, প্রস্তর নির্মিত বিষ্ণুপট্টের ভগ্নাংশ ও বহু কড়ি পাওয়া গেছে। প্রথম পর্যায়ে প্রাপ্ত স্থাপত্যের কাঠামো ও প্রত্নবস্তুর সাথে পাল আমলের কাঠামো ও প্রত্নবস্তুর সাদৃশ্য রয়েছে। অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে প্রাপ্ত এ সকল নিদর্শন থেকে ধারণা করা যায়, এখানে অষ্টক শতক বা পাল আমলের নির্মিত ইমারতের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।
রাজা পরশুরামের প্রাসাদের উপরের স্তরে অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে নির্মিত একটি বিরাট আবাস বাটির সম্পূর্ণ নকশা উন্মোচিত হয়েছে। অন্দর মহলে অবস্থিত ছোট একটি অঙ্গনের দিকে মুখ করে নির্মিত পৃথক পৃথক ৪টি মহল বা অংশের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মোহগুলোর প্রবেশ পথ সহ বেশ কিছু কক্ষ, সোপান শ্রেণী, সীমানা প্রাচীর এবং পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি প্রবেশদ্বার আবিষ্কৃত হয়েছে।
মুল প্রবেশদ্বার হচ্ছে পূর্ব পাশের প্রবেশদ্বার। যার দুই পাশে দুইটি প্রহরী কক্ষের নিদর্শন দেখা যায়। উপরিভাগে মোঘল ও ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত ছোট আকারে ইট, চুন সুরকীর আস্তর, চুনকামের ব্যবহার, গঠনশৈলী ইত্যাদি দেখে অনুমান করা যায় যে, এই ইমারত অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে নির্মিত হয়েছিল।
মানকালিড় ঢিবি:—
মহাস্থানগড়ের ভেতর যে সমস্ত প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায় তার মধ্যে মানকালী কুন্ড ঢিবি উল্লেখযোগ্য। এটি মহাস্থানগড়ের মজা পুকুরের পূর্বপাড়ে অবস্থিত। ১৯৬৫-৬৬ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে এখানে খননকাজ শরু হয় ও শেষ পর্যন্ত সুলতানি আমলের একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষসহ বেশ কিছু ছোট ছোট প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু আবিষ্কার করা হয়।
মসজিদটির আয়তন ২৬.২১ থেকে ১৪.৫৪ মিটার। খনন কাজ চলার সময় মসজিদের নিচে একটি মন্দিরেরও কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল। মসজিদটিতে কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি তবে মসজিদের অবকাঠামো দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ধারণা করেন এটি খুব সম্ভবত মুঘল আমলের পূর্বেই নির্মাণ করা হয়েছিল।
মানকালীর ঢিবির পাশে একটি ছোট জলাশয় রয়েছে ও জলাশয়টি থেকে ঢিবিটি দেখতে উঁচু মনে হওয়ায় এটি কুন্ড বা (কূপ) নামে পরিচিত। দুটি মিলে এই স্থাপনাকে মনকালীর কুন্ডধাপ নামে ডাকা হয়। কিংবদন্তি অনুসারে, এই স্থানে প্রথমে একটি মন্দির নির্মাণ করেন রাজা মানসিংহ ও তার ভাই তানসিংহ। অন্যান্য কিংবদন্তি অনুসারে, এখানে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন ঘোড়াঘাটের জমিদারগণ এছাড়াও এখানে পাওয়া জৈন প্রতিমা দেখে অনেকেই মনে করেন পূর্বে জৈন ধর্মগুরুদের আবাসস্থল ছিলো স্থানটি।
খোদার পাথর:—
মহাস্থানগড়ে অবস্থিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান খোদার পাথর ভিটা। মহাস্থানগড়ের ভিতরে শাহ সুলতান বলখী (রঃ) মাজারের উত্তর-পশ্চিম দিকে সামান্য হাঁটলে পেয়ে যাবেন এ প্রত্নস্থানটি।
মূলত এটি একটি বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরটি অষ্টম শতকে (পাল আমলে) নির্মিত বৌদ্ধ মন্দির। তবে মজার বিষয় হল প্রত্নস্থানটির “খোদার পাথর ভিটা” নামকরণটি হয়েছে এখানে অবস্থিত একটি লম্বা পাথরখন্ডকে কেন্দ্র করে। সে বিষয়ে পরে আসছি।
যেহেতু পাথরটিতে নকশা খোদাই করা আছে, সেজন্য একে ‘খোদাই পাথর’ বলা হতো, যা কালক্রমে ‘খোদার পাথর” নামে পরিচিতি পেয়েছে।
যেভাবে যাবেন পরশুরামের প্রাসাদে—
বগুড়া শহরের সাতমাথা থেকে খানিকটা উত্তরে অবস্থিত দত্তবাড়ি সিএনজি স্ট্যান্ড। সেখানে গিয়ে দেখা যাবে সিএনজি চালকরা ডাকাডাকি করছে। এই জায়গা থেকে জন প্রতি ৩০ টাকায় গোকুল ব্যাসট্যান্ডে যাওয়া যাবে। সেখান থেকে ৫ টাকা খরচ করলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে গোকুল মেধে।
Leave a Reply